কম্পিউটার প্রযুক্তির ইতিহাসে একটি মাইলফলক হলো এনিয়াক (ENIAC)। এটি বিশ্বের প্রথম বৈদ্যুতিন ডিজিটাল প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার যা গণনা এবং ডেটা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এনিয়াকের উদ্ভাবন আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে।
এনিয়াক কী?
এনিয়াক শব্দটি হলো Electronic Numerical Integrator and Computer-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি ছিল প্রথম সাধারণ উদ্দেশ্যপ্রাপ্ত প্রোগ্রামেবল কম্পিউটার যা বৈদ্যুতিন উপাদান ব্যবহার করে দ্রুত ও নির্ভুল গণনা করতে সক্ষম ছিল।
উদ্ভাবকের নাম
এনিয়াক তৈরি করেন দুই জন মার্কিন প্রকৌশলী জন প্রেসপার একার্ট (John Presper Eckert) এবং জন উইলিয়াম মকলি (John William Mauchly)। ১৯৪৩ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৪৫ সালে শেষ হয়। এটি ১৯৪৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জনসাধারণের কাছে প্রদর্শিত হয়।
এনিয়াকের প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
হার্ডওয়্যার উপাদান
- ভ্যাকুয়াম টিউব: ১৭,৪৬৮টি ভ্যাকুয়াম টিউব ছিল যা দ্রুত গতির তথ্য প্রক্রিয়াকরণে সহায়ক ছিল।
- রিলেস এবং ক্যাপাসিটার: ডেটা স্টোরেজের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- রেজিস্টার ও সুইচ: তথ্য নিয়ন্ত্রণ ও মেমোরি স্টোরেজে সাহায্য করত।
মেমোরি এবং স্টোরেজ
ENIAC এর মেমোরি এবং স্টোরেজ পদ্ধতি বর্তমানে প্রাগৈতিহাসিক মনে হলেও, এটি আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
ENIAC-এ কোনও RAM বা হার্ড ড্রাইভ ছিল না। এটি অ্যাকুমুলেটর (Accumulator) নামে পরিচিত ২০টি রেজিস্টার ব্যবহার করত, যা মূলত সংখ্যাগুলি সংরক্ষণ এবং গাণিতিক হিসাব পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হতো।
প্রতিটি অ্যাকুমুলেটর ১০-সংখ্যার দশমিক মান সংরক্ষণ করতে পারত।
ENIAC-এ স্থায়ী ডেটা স্টোরেজের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। প্রোগ্রাম এবং ডেটা সংরক্ষণের জন্য এটি পাঞ্চ কার্ড (Punch Card) এবং ক্যাবল সংযোগ ব্যবহার করত। প্রোগ্রামিং ম্যানুয়ালি তার সংযোগ এবং সুইচ সেটিংস পরিবর্তন করে করা হতো।
প্রসেসিং ক্ষমতা
এনিয়াক প্রতি সেকেন্ডে ৫,০০০ পর্যন্ত যোগ-বিয়োগ এবং ৩৬০টি গুণ বা ভাগ করতে পারত। এটি সেই সময়ের জন্য একটি অসাধারণ ক্ষমতা ছিল।
এনিয়াকের ব্যবহার এবং অবদান
সামরিক খাতে
এনিয়াকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্টিলারি ফায়ারিং টেবিল তৈরি করা। এটি ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ হিসাব করত এবং বিভিন্ন গাণিতিক মডেল তৈরি করত।
১. বোমার বিস্ফোরণ গণনা:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, মার্কিন সেনাবাহিনী পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ গণনার জন্য উন্নত গণনামূলক ক্ষমতার প্রয়োজন অনুভব করে। ENIAC ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজেক্টাইল এবং ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ নির্ধারণ করা হয়, যা দ্রুত এবং নির্ভুল ফলাফল দিত।
২. হাইড্রোজেন বোমা উন্নয়ন:
ENIAC-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কাজ ছিল হাইড্রোজেন বোমার উন্নয়নে সহায়তা করা। ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে এডওয়ার্ড টেলার এবং স্ট্যানিস্ল ফ্লামিন্টের নেতৃত্বে হাইড্রোজেন বোমার থিওরেটিক্যাল গণনা করা হয়। ENIAC এই জটিল গণনাগুলি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে।
৩. সামরিক গবেষণা এবং উন্নয়ন:
ENIAC এর সাহায্যে সামরিক গবেষণাগারগুলি উচ্চ গতির গণনার মাধ্যমে নতুন অস্ত্র তৈরির নকশা এবং বিভিন্ন সামরিক কৌশল বিশ্লেষণ করত। এটি পরবর্তী সময়ে যুদ্ধকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এনিয়াকের অবদান
এনিয়াক (ENIAC - Electronic Numerical Integrator and Computer) কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই নয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও অসামান্য অবদান রাখে। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম প্রোগ্রামেবল ইলেকট্রনিক কম্পিউটার যা গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, আবহাওয়া, এবং মহাকাশ গবেষণার মতো বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রগুলিতে নতুন দ্বার উন্মোচন করে।
১. গণিত এবং পরিসংখ্যান গবেষণা:
ENIAC-এর উচ্চ-গতির গণনাশক্তি জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করা হয়। গণিতবিদ ও পরিসংখ্যানবিদরা বড় আকারের সংখ্যাসমূহের বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যানগত মডেলিং এবং সিমুলেশন পরিচালনা করতে ENIAC ব্যবহার করতেন।
২. পারমাণবিক শক্তি ও পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা:
ENIAC পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কিত তাত্ত্বিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। হাইড্রোজেন বোমা তৈরির জন্য জটিল গাণিতিক মডেল এবং পারমাণবিক বিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা হতো। এই গবেষণাগুলি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার ভিত্তি গড়ে তোলে।
৩. মহাকাশ গবেষণা:
মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে রকেট এবং কক্ষপথ সম্পর্কিত গণনাগুলি ENIAC দিয়ে পরিচালিত হতো। এটি উপগ্রহ এবং মহাকাশযানের গতিপথ, মহাকাশ অনুসন্ধান এবং রকেট উৎক্ষেপণের জটিল গণনাগুলি দ্রুত সমাধান করতে সক্ষম ছিল।
৪. আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং জলবায়ু গবেষণা:
ENIAC-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক অবদান ছিল প্রথম ডিজিটাল আবহাওয়া পূর্বাভাস প্রদান। ১৯৫০ সালে, আবহাওয়াবিদ জন ভন নিউম্যান এবং জুলেস চার্নি আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল তৈরি করেন। ENIAC ব্যবহার করে বিশ্বের প্রথম আবহাওয়ার পূর্বাভাস সাফল্যের সাথে করা হয়, যা আধুনিক জলবায়ু মডেলিং প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।
৫. জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং মহাজাগতিক গবেষণা:
ENIAC জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের মডেলিং, কক্ষপথ বিশ্লেষণ এবং মহাবিশ্বের প্রসারণের মতো তাত্ত্বিক গবেষণায় সহায়ক ছিল।
এনিয়াকের সীমাবদ্ধতা
বিশাল আকার
এনিয়াক ছিল ১,৮০০ বর্গফুট জায়গা জুড়ে স্থাপনকৃত একটি বিশাল যন্ত্র। এর ওজন ছিল প্রায় ৩০ টন।
প্রোগ্রামিং জটিলতা
এনিয়াক প্রোগ্রামিং করা ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। মেশিনটি চালু বা প্রোগ্রাম পরিবর্তন করতে অনেক সময় লাগত।
উচ্চ বিদ্যুৎ খরচ
এটি ১৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করত, যা একটি ছোট শহরের বিদ্যুৎ খরচের সমান ছিল।
এনিয়াকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
এনিয়াকের উদ্ভাবন কম্পিউটার প্রযুক্তির এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এটি আধুনিক কম্পিউটারের ডিজিটাল স্থাপত্যের ভিত্তি স্থাপন করে এবং ভবিষ্যতের কম্পিউটার নকশার জন্য রোডম্যাপ তৈরি করে। আজকের সুপার কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির মূলেও এনিয়াকের কনসেপ্ট রয়েছে।
উপসংহার
এনিয়াকের উদ্ভাবন ছিল বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত ইতিহাসের এক বিশাল অর্জন। এটি বিশ্বের প্রথম বৈদ্যুতিন ডিজিটাল কম্পিউটার হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং আধুনিক যুগের স্মার্ট ডিভাইসগুলোর পেছনে এনিয়াকের অনন্য অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
0 Comments